Source: http://www.mzamin.com/index.php?option=com_content&view=article&id=40395:2012-04-11-16-38-31&catid=48:2010-08-31-09-43-22&Itemid=82
ইন্দোনেশিয়ায় ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প পরবর্তী সুনামি সতর্কতায় বাংলাদেশসহ কমপক্ষে ২৮টি দেশ আতঙ্কে ডুবেছিল। গতকাল ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের কাছে সৃষ্ট ভূমিকম্প ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল আন্দোলিত করে। এতে প্রথমদিকে বাংলাদেশসহ ২৮টি দেশে সুনামি সতর্কতা জারি করা হলেও গতকাল সন্ধ্যার দিকে তা প্রত্যাহার করা হয়। বলা হয় সুনামি হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে গেছে। তারপরও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাটছে না। এর আগে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে গত রাতে আঘাত হানতে পারে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়। বলা হয়, এর উচ্চতা হতে পারে কয়েক ফুট। ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে গতকাল দু’দফা ভূমিকম্প আঘাত হানে। প্রথমে বলা হয়েছিল এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৯। কিন্তু পরে তা সংশোধন করে ৮ দশমিক ৬ বলা হয়। দু’দফা কম্পনের প্রভাব পড়েছে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে। বাংলাদেশের প্রায় সব স্থানে গতকাল বিকাল পৌনে তিনটার দিকে অনুভূত হয় এ ভূমিকম্প। এ সময় মানুষজন ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের ২৮টি দেশে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়। তার মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, বৃটেন, মালয়েশিয়া, মৌরিতানিয়া, সিসিলি, পাকিস্তান, সোমালিয়া, ওমান, মাদাগাস্কার, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন, তাঞ্জানিয়া, মোজাম্বিক, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও সিঙ্গাপুর। আন্দামান, নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং ভারত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে জারি করা হয় সুনামির লাল সতর্কতা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় সুনামি সতর্কীকরণ কেন্দ্র ও জাপান আবহাওয়া অফিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া দপ্তর জানায়, বাংলাদেশের স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৫১ মিনিটে সুনামি আঘাত হানতে পারে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর উপকূলীয় অঞ্চলে সুনামি সতর্ক বার্তা দেয়। পরে তা প্রত্যাহার করা হয়। ভূমিকম্পের সময় চট্টগ্রামের মেহেদীবাগের বহুতলবিশিষ্ট অ্যাম্বাসেডর ভবন হেলে পড়েছে। সুনামি সতর্কতা জারির পর চট্টগ্রাম নগরীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের সুনামি সতর্কীকরণ কেন্দ্র পূর্ব উপকূলে ৬ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাসের সতর্কতা জারি করলেও পরে তা প্রত্যাহার করে। ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে লোকজনকে উঁচু স্থানে সরে যাওয়ার জন্য সতর্ক করে বাজানো হয় সাইরেন। মসজিদে মসজিদে মাইকে তেলাওয়াত করা হয় পবিত্র কোরান। এ ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এ অঞ্চলজুড়ে। ইন্দোনেশিয়ার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ বলেছে, আচেহ প্রদেশ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মানুষ রুদ্ধশ্বাসে উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়ার জন্য ছুটছে। ওই সংস্থার মুখপাত্র সুতোপো বলেছেন, আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে মানুষ পড়িমড়ি করে ছুটছে। ফলে রাস্তায় রাস্তায় গতকাল সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুসিলো বামবাং ইয়োধোইয়োনো জানিয়েছেন, আচেহ প্রদেশে কোন ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায় নি। যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে বলেছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল সমুদ্রের ২০ মাইল নিচে। আচেহ প্রদেশের রাজধানী বানডা থেকে তার দূরত্ব ৩০৮ মাইল। ওই ভূমিকম্পের আঘাত গতকাল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুভূত হয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ৯ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। তাতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সুনামিতে মারা যান ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ। তার মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ আচেহ প্রদেশের। শ্রীলঙ্কা সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, গ্রিনিচ মান সময় ১০:৪০টায় সুনামি আঘাত হানতে পারে দেশটির পূর্ব উপকূলে। জরুরিভিত্তিতে সরকার উপকূলীয় এলাকা থেকে মানুষজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। থাইল্যান্ডে জাতীয় দুর্যোগ সতর্কীকরণ কেন্দ্র দেশবাসীকে উঁচু স্থানে সরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তাদের বলেছে, যতটুকু সম্ভব সমুদ্র থেকে দূরে সরে যেতে। থাইল্যান্ডের ফুকেত পর্যটন কেন্দ্র থেকে ভূমিকম্পের সময়ই লোকজনকে সরিয়ে নেয়া শুরু হয়। সেখানে উপস্থিত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক বনি মাডল বলেছেন, খ্রাবি ও ফাং নাগ উপসাগর থেকেও পর্যটকদের সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয় তাৎক্ষণিকভাবে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে কলকাতায়। সেখানে আকাশচুম্বী ভবনগুলোর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেশি দেখা দেয়। ভূমিকম্প আঘাত হানার পরই সেসব ভবন থেকে লোকজন নিচে নেমে আসতে থাকে। কলকাতা মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ ওই ভূমিকম্পের পর পরই সকল মেট্রো রেল চলাচল সাময়িক বন্ধ করে দেন। রেললাইনে বা ভূতলে রেলের কোন স্থানে মারাত্মক ধরনের কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা তা দেখতে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়। কলকাতার সল্ট লেক এলাকার সেক্টর ভি-তে আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি। তবে কোথাও কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায় নি। সিএনএন-এর এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভূমিকম্পের পর সৃষ্ট সুনামি ২০০৪ সালের মতো প্রলয়ঙ্করী না-ও হতে পারে। গতকাল রাজধানীসহ গোটা দেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। দুপুর পৌনে তিনটায় ভূমিকম্পটি শুরু হয়ে বেশ কিছুক্ষণ স্থায়ী হয়। বাংলাদেশে কম্পনের মাত্রা পরিমাপ করা হয়নি বলে জানান আবহাওয়া অফিসের বিশেষজ্ঞ শামসুদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে কম্পন সৃষ্টি হয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক হুমায়ূন আখতার জানান, তাদের পরিমাপক যন্ত্রে ঢাকায় ৩.৮ মাত্রার কম্পন হয়েছে।
চট্টগ্রামে সুনামি আতঙ্ক
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে জানান, ‘ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকম্পের ধাক্কা বঙ্গোপসাগরের তীর চট্টগ্রামে আঘাত হানতে পারে’- এমন একটি খবরে গতকাল বন্দর নগরী চট্টগ্রামে সবার মনে আতঙ্ক বিরাজ করে। এর আগে ভূমিকম্পে নগরীর একটি শক্তিশালী বহুতল ভবন হেলে পড়লে সবার মধ্যে ছুটোছুটি শুরু হয়। লোকজন কাজের ব্যস্ততা কমিয়ে দিয়ে প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপদ স্থানে যেতে শুরু করেন। সন্ধ্যার পর হঠাৎই কর্মব্যস্ত শহর ফাঁকা হয়ে যায়।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গতকাল বিকাল ৪টা থেকে চট্টগ্রাম সাগর তীরে সুনামির আঘাত হানার খবরটি প্রকাশ করতে থাকে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। এতে জানানো হয়, ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে গতকাল ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের পর বিশ্বের ২৮টি দেশের সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরও রয়েছে। সংবাদটি নিশ্চিত করে আগাম সতর্কতা হিসেবে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর উপকূলীয় অঞ্চলে সুনামি সতর্কবার্তা জারি করলে বিষয়টি প্রকট হয়। তারা জানান, বাংলাদেশ স্থানীয় সময় রাত ১০টা ৫১ মিনিটে সুনামিটি চট্টগ্রাম অঞ্চলে আঘাত হানতে পারে। এর উচ্চতা হতে পারে ১৮ ফুটের বেশি।
আবহাওয়া দপ্তরের কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান বলেন, ‘সুনামির আঘাত হানার বিষয়টি একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। এই বিষয়ে ওপর থেকে আমরা দ্রুত নির্দেশ পেয়েছি। গতকাল বিকালে ৩টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এটি আঘাত হানলে চট্টগ্রাম বন্দরে আগে হানার সম্ভাবনা রয়েছে।’
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, সুনামির হাঘাত আনার আগেই গতকাল সন্ধ্যা থেকে তারা আগাম প্রস্তুতি নেয়। চট্টগ্রাম নগরীর ১৩টিসহ বিভাগের ৫৭টি ফায়ার সার্ভিস স্টেশনকে যে কোন মুহূতে ছুটে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। নগরীর আগ্রাবাদ, ইপিজেড, ডক, বায়েজিদ, কালুরঘাট, নন্দনকানন, চন্দনপুরা, সীতাকুণ্ড, কুমিরা ও লামারবাজারে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশনের কর্মকর্তারা সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়ার বিষয়টি মানবজমিনের কাছে নিশ্চিত করেছেন। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ডিডি) রুহুল আমিন ইউনিটগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকার কথা জানান।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, সুনামির বিষয়টি আমলে নিয়ে গতকাল বিকালে জরুরি বৈঠকে বসেন বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বৈঠক থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর ও জেটিতে অবস্থানরত সব জাহাজকে সুনামি সতর্কতা পৌঁছে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর জাহাজগুলোক সাবধানে চলাচল করতে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়।
সুনামি সতর্কতার অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সব কার্যক্রম বুধবার রাত ৮টা থেকে ১০ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে।
চট্টগ্রাম বিমানবন্দর সূত্র জানায়, সুনামি সতর্কতার অংশ হিসেবে গতকাল রাত ৮টা থেকে আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত বিমানবন্দরের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ম্যানেজার স্কোয়াড্রন লিডার রবিউল ইসলাম ফোনে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে গতকাল দু’দফা ভূমিকম্পে চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদীবাগে ‘এম্বেসি বিল্ডিং’ নামে ছয় তলা একটি আবাসিক ভবন হেলে যায়। এতে লোকজনের মনে ভয় ঢুকে যায়। কয়েকটি পরিবার ভবনটি ছেড়ে নিরাপদে অন্যত্র চলে যায় বলে জানান।
নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টসের ছয় তলায় ফাটল
স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, গতকাল বুধবার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে সারাদেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও ভূমিকম্প হয়েছে। ভূমিকম্পের কারণে শহরের উঁচু ভবন থেকে সেগুলোর বাসিন্দারা দ্রুত নিচে নেমে আসে। বিশেষ করে শহরের গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যে কারণে গার্মেন্টস শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প সিঁড়ি ব্যবহার করে দ্রুত নিচে নেমে আসে। এদিকে ভূমিকম্পের কারণে সদর উপজেলার ফতুল্লার পঞ্চবটি বিসিক শিল্প নগরীতে অবস্থিত রপ্তানিমুখী কনক গার্মেন্টসের ছয় তলায় ফাটল দেখা দিয়েছে। এছাড়া, অন্য কোথাও থেকে আর কোন খবর পাওয়া যায়নি।
No comments:
Post a Comment