জাপানের অন্যতম একটি বনের নাম অকিগাহারা। এর সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট ফুজি (স্থানীয়ভাবে জুকাই নামে পরিচিত) খুবই মনোমুগ্ধকর একটি প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থান। ঘন গাছ-গাছালিতে ভরা নিঝুম প্রাকৃতিক পরিবেশের বন ও এর চূড়া তার সৌন্দর্যের চেয়েও বেশি আলোচনায় এসেছে সুইসাইড ফরেস্ট বা আত্মত্যার বন হিসেবে। কারণ ওই চূড়াটি থেকে প্রতিবছর কমপক্ষে ১শ’টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তবে এখানে আত্মহত্যার পরিমাণ যে আরও অনেক বেশি তার প্রমাণ দিতেই যেন মাঝে মাঝে সেখানে কঙ্কাল ও মানুষের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় দৃষ্টিগোচর হয়।
কিন্তু কেন মানুষ এই মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক নৈস্বর্গকে বাছাই করে নেয় আত্মহত্যার মতো জঘন্য ও চূড়ান্ত কাজটি করার জন্য। প্রকৃতি তো মানুষের বন্ধু। সে তো মানুষকে বাঁচতে শেখায়। প্রচণ্ড ঝড়-ঝাঁপ্টার পরও কিভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে তা দেখায়। অথচ জীবনের হতাশা থেকে মুক্ত হয়ে সাহসী গাছ-গাছালির কাছে এসে নিজের সবচেয়ে দামি জীবনকে সমর্পণ করে দেয় অসহায় মানুষ। সমপ্রতি এটি নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করার পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। ডকুমেন্টারিতে বলা হয়, কেন মানুষ এখানে আত্মহত্যা করতে আসে বিষয়টি একটি রহস্য। তবে ধারণা করা হয়, ওই জায়গাটি নিয়ে লেখা একটি উপন্যাস থেকে উৎসাহিত হয়ে এটা করে থাকতে পারে মানুষ। অকিগাহারো বন নিয়ে দীর্ঘ ৩০ বছর গবেষণা করা ভূতত্ববিদ আজুসা হিয়ানো বলেন, গত বিশ বছরে তিনি নিজে এখানে ব্যক্তিগতভাবে ১শ’টি মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন। এছাড়াও অসংখ্য কঙ্কাল ও মানুষের বিভিন্ন রকম কাপড়-চোপড় পেয়েছেন-যা আত্মহত্যার নিদর্শন বহন করে।
এছাড়াও বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া যায় যেগুলো থেকে ধারণা করা যায় জীবনের শেষ মুহূর্তে মানুষ কি ভাবে। কখনও শেষ মুহূর্তে এসে কেউ কেউ প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রভাবিত হয়ে ফিরেও যায়।
মি. হিয়ানো বলেন, অনেক সময় মানুষের শেষ মুহূর্তের সঙ্গী পুতুল খুঁজে পাওয়া যায় বনটিতে। গাছের সঙ্গে পেরেক দিয়ে লাগানো পুতুল দিয়ে বোঝানো হয় প্রচলিত সমাজ ও এর মানুষের প্রতি ঘৃণা। বিভিন্ন সময় অনেক মানুষকে দেখে মি. হিয়ানো আত্মহত্যা না করার জন্য অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেন। তবে কেউ শোনে কেউবা এড়িয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করে বলে মনে করেন তিনি। ডকুমেন্টারিটির শুরুতে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দেখানো হয়। মি. হিয়ানো বলেন, অনেক মাস ধরে এটা এখানে পড়ে আছে। মনে হয় এর মালিক গাড়ি নিয়ে এসে আত্মহত্যা করেন। ফলে এটি এখানে পড়ে আছে। বিভিন্ন সময় গাছে ঝোলানো দড়ি, ফাঁস ও বিভিন্ন কথা লেখা দেখা যায়। যেগুলো থেকে সমাজের প্রতি ঘৃণার বিষয়টি ফুটে ওঠে। বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন আত্মহত্যা থেকে নিরুৎসাহিত করতে অনেক প্রচার করে থাকে। যেমন সুইসাইড প্রিভেনশন অ্যাসোসিয়েশন এর একটি প্রচার সাইনবোর্ড আছে যেখানে লেখা- ‘আপনার জীবন বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে একটি অমূল্য উপহার, দয়া করে নিজের মা-বাবা, ভাই-বোনের কথা ভাবুন, সমস্যা নিজের মধ্যে না রেখে সবার সঙ্গে আলোচনা করুন’। বর্তমানে অবশ্য আত্মহত্যার পরিমাণ অনেক কমেছে বলে মনে করা হয়। আগে যেখানে সম্মান রক্ষার জন্য দল বেধে আত্মহত্যা করা হতো জাপানে। বর্তমানে সেটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে করা হয়।
তবে এখনও যেসব মানুষ আত্মহত্যা করে তার বেশির ভাগই এর জন্য নীরব ও সুন্দর অকিগাহারা বনের মাউন্ট ফুজি চূড়াটিকে বেচে নেয়ায় এটি আত্মহত্যা বন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
No comments:
Post a Comment