মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি

প্রথম বাংলাদেশী নারী হিসেবে এভারেস্ট চূড়ায় আরোহণ করা
নিশাত মজুমদার ও তার সঙ্গী এমএ মুহিত বর্তমানে বেজ ক্যাম্পে অবস্থান
করছেন। সেখান থেকে বিবিসিকে একটি সাক্ষাৎকার দেন তিনি। বাংলাদেশে প্রথম
নারী হিসেবে এভারেস্ট চূড়া স্পর্শ করার অনুভূতি কেমন ছিল? এর জবাবে নিশাত
মজুমদার বলেন, আসলে এটা একটা অন্যরকম অনুভূতি। ভাষায় প্রকাশ করাটা কঠিন
আমার জন্য। তারপরও অনেক অনেক অনেক ভাল লাগা। আমাদের দেশের মেয়েদের যে
অবস্থা সেখান থেকে এমন একটা জায়গার উচ্চতায় আরোহণ করাটা খুব কঠিন। তারপরও
ওরা আমাদেরকে নিয়ে যখন দেখবে যে একটা মেয়ে এই কাজটা করতে পারছে। এমন একটা
কঠিন কাজ। সুতরাং আমরা এর চেয়ে কঠিন কাজ করতে পারবো। এবারের এভারেস্ট আরোহণ
আপনার জন্য কতটা কঠিন ছিল। কারণ আমরা জানি আবহাওয়া অনেক খারাপ ছিল।
কয়েকদিন আগেও কয়েকজন পর্বতারোহী মারা গেছেন। তো আপনার জন্য পরিস্থিতিটা
কেমন ছিল। জবাবে নিশাত বলেন, অসম্ভব রকমের কঠিন। এটা আমার চাইতে মুহিত
ভাইয়া ভাল বলতে পারবেন। ভাইয়া বলছিলেন, তিব্বত দিয়ে গতবার উঠেছেন। উনি
বলছেন তিব্বতের চাইতে এটা বিশগুণ কঠিন। অনেক বেশি লম্বা রাস্তা। তাছাড়া
টেকনিক্যাল ডিফিকাল্টও বেশি। সবকিছু মিলে এটা ছিল অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
আমার কাছে মনে হয়েছে যে, এত বেশি কঠিন জানলে হয়তো আমি আসতাম না। এখন কি মনে
হচ্ছে। এসে ভুল করেছেন, না ঠিক করেছেন। এমন প্রশ্নে নিশাত বলেন, এখন বেজ
ক্যাম্পে বা নিরাপদ জায়গায় আছি। এখন মনে হচ্ছে ঠিক আছে। কিন্তু যতক্ষণ
পর্যন্ত বেজ ক্যাম্পে না পৌঁছেছি- ততক্ষণ পর্যন্ত মনে হয়েছে না কেন এসেছি।
কি দরকার ছিল আসার। এতো কষ্ট কেন করেছি। এতো কষ্ট করে কি দরকার
পর্বতারোহণের। একটা প্রশ্ন খালি ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মনের মধ্যে। কেন মানুষ
এতো কষ্ট করে পর্বতারোহণ করে। আমি এর কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। এতো কষ্ট
করে কি দরকার পর্বতারোহণ করার। তো এভারেস্টের শীর্ষে পা রেখে সেই প্রশ্নটার
কি কোন উত্তর পেয়েছেন? এর জবাবে নিশাত বলেন, এখনও নিজেকে সন্তুষ্ট করার
মতো উত্তর পাইনি। আবহাওয়ারও তো খুব একটা সহযোগিতা আপনারা পাননি-এর উত্তরে
নিশাত জানান, হ্যাঁ আবহাওয়াটা প্রচণ্ড রকমের খারাপ ছিল। আমরা যখন সামিটে
ছিলাম। সামিটে আমাদের সময়টা এতো খারাপ ছিল যে, আমি সৃষ্টিকর্তাকে বলছিলাম,
তুমি এত কষ্ট করে আমাদেরকে নিয়ে এসেছো। কিন্তু আমাদেরকে সময়টা উপভোগ করতে
দিলে না। প্রচণ্ড বাতাস ছিল। মনে হচ্ছিল আমি উড়ে যাবো। এরকম একটা অবস্থা।
তারপর যখন নেমে আসছি সেখান থেকে ৩শ’ সাড়ে ৩শ’ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইছিল।
আমাদের মনে হয়েছিল আমরা যে চারজন ছিলাম আমাদেরকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। কি যে
ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ছিল। না দেখলে এটা বোঝানো যাবে না। ঠিক চূড়ায় আরোহণ এবং
শীর্ষ চূড়া স্পর্শ করার পর ঠিক সেই সময়ের অনুভূতিটা কেমন ছিল। কি মনে
হয়েছিল। জবাবে নিশাত মজুমদার বলেন, আমার একটি সমস্যা ছিল। চোখে দেখতে
পাচ্ছিলাম না। উপর থেকে ক্যাম্পে ফিরে আসা পর্যন্ত আমি চোখে দেখছিলাম না।
ঝাপসা দেখছিলাম। যার জন্য এভারেস্টের চূড়া থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ জায়গা
থেকে যে পৃথিবীটা দেখা যায়। দেখতে কেমন। আমি তখন সৃষ্টিকর্তাকে বলছিলাম
তুমি যখন আমাকে নিয়ে আসছো তবে ভালভাবে দেখতে পর্যন্ত দিচ্ছো না। দেখতে
পাচ্ছি তবে ঝাপসা। এই কষ্টটা তখন ছিল। বিশ্বাস হচ্ছিল না নিজেকে যে আমি
ওখানে আছি। আপনি জানেন প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী আপনাকে অভিনন্দন
জানিয়েছেন। আপনার এই কৃতিত্ব নিয়ে দেশে বিরাট হইচই পড়ে গেছে। নিশ্চয়ই দেশে
ফেরার জন্য মুখিয়ে আছেন। এর জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই বাবা-মা’র কাছে,
পরিবারের কাছে যেতে তো খুব ইচ্ছা করছে। আমার যখন টার্গেট থাকে সেটা স্পর্শ
করা হলো মুখ্য বিষয়। কিন্তু যখন সেটা হয়ে যায় তখন মনে হয় কখন বাসায় যাবো।
এখনো তাই। বাংলাদেশে যারা আপনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাদের জন্য
কোন বার্তা- নিশাত বলেন, সবার প্রতি আমার অশেষ অশেষ কৃতজ্ঞতা। আপনাকে
বললাম না যে, আমরা অনেক বিপদে পড়েছিলাম। একেবারে মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখে
এসেছি। আমাদের তো মনে হয়েছিল আমার নতুন জন্ম। দ্বিতীয় জন্ম। অলৌকিকভাবে
বেঁচে যাওয়া। যখন দেখলাম আমরা চারজন মানুষ ওই বিপদে পড়লাম। চারজন মানুষ
সুস্থ আছি। কোন সমস্যা হয়নি। তখন আমার কাছে একটা কথাই মনে হয়েছে। যে দেশের
মানুষ আমাদের জন্য এত বেশি দোয়া করেছেন যে, তার জন্যই আজকে আমরা এভাবে
বেঁচে ফিরতে পেরেছি। তা না হলে কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। ওই বিপদ থেকে এভাবে
ফিরে আসা। আমাদের সঙ্গে অন্য একজন শেরপা ছিল যার একজন পড়ে গিয়ে বুকের হাড়
ভেঙে গেছে। তাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা চারজন মানুষ সুস্থ আছি।
আমার কাছে মনে হয়েছে এটা অস্বাভাবিক। মনে হচ্ছে যে এটা আমাদের দেশের
মানুষের দোয়ার জন্যই সম্ভব হয়েছে। তাদের সবার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।
মা আমি আকাশ ছুঁয়েছি
স্টাফ
রিপোর্টার জানান, বেস ক্যাম্পে পৌঁছে উচ্ছ্বসিত নিশাত মাকে ফোন করে বললেন,
মা আমি আকাশের কাছে গিয়েছিলাম। আবেগ আপ্লুত মা আসুরা মজুমদার জানতে
চাইলেন, তুই কেমন আছিস মা? নিশু জবাব দিলেন, মা ভাল আছি, বেঁচে আছি তোমাদের
দোয়ায় এবং দেশের মানুষের ভালবাসয়। তুষার ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম, সামান্য আহতও
হয়েছি তবে ফিরে এসেছি, সফল হয়েছি, বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চ পর্বতের চূড়ায় উঠে
বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। তোমরা বাড়ির সকলে কেমন আছো? গতকাল বেলা ২টার
দিকে বেস ক্যাম্প থেকে মোবাইল ফোনে ঢাকায় মায়ের সঙ্গে কথা বলেন এভারেস্ট
জয়ী প্রথম বাংলাদেশী নারী নিশাত মজুমদার। বেলা ১টার দিকে নিশাত মজুমদার এবং
এমএ মুহিত ক্যাম্প ২ থেকে বেস ক্যাম্পে এসে পৌঁছান। নিশাত মজুমদারের মা
আসুরা মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, নিশাতের গলা বসে গেছে কথা বলতে পারছিল না।
কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। এভারেস্ট বিজয়ে নিশাত খুব খুশি। সে দেশবাসীর
প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে, সকলের দোয়া চেয়েছে। আসুরা মজুমদার জানান, মুহিতের
সঙ্গেও কথা হয়েছে। তারা ভাল আছে বলে মুহিত জানিয়েছে।
বাংলা
মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রাকিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা, ক্লাবের উপদেষ্টা
ইনাম আল হক জানিয়েছেন বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে তার সঙ্গে নিশাত ও মুহিতের কথা
হয়েছে, বেস ক্যাম্পে পৌঁছে তারা ফোন করেছিল। ২৪ বা ২৫শে মে তারা বেস
ক্যাম্প থেকে লুকলার উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করবেন। সেখান থেকে
নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডু পৌঁছাতে আরও তিন দিন সময় লেগে যেতে পারে। ধারণা
করা হচ্ছে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ২৮শে মে নিশাত-মুহিত কাঠমাণ্ডু পৌঁছাতে
পারেন। তিনি জানান, নিশাত-মুহিত এখন শারীরিকভাবে ভাল আছে তবে ফেরার পথে
তারা তুষার ঝড়ের কবলে পড়েছিল। ঝড়ের কবলে পড়ে নিশাত সামান্য আহত হয়েছে
কিন্তু অক্ষত অবস্থায় বেস ক্যাম্পে ফেরত এসেছে।
জানা গেছে, নিশাত-মুহিতের সঙ্গে ছিলেন নেপালি তিনজন শেরপা।
বাংলা
মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রাকিং ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ নুর মোহাম্মাদ
মানবজমিনকে বলেন, বেলা ২টার দিকে নিশাত-মুহিত বেস ক্যাম্পে খাওয়া-দাওয়া
করেছেন। তাকে ফোনে জানিয়েছেন ২৮শে মে নাগাদ তারা নেপালের রাজধানী
কাঠমাণ্ডুতে পৌঁছাতে পারেন তবে অনেক পথ পায়ে হেঁটে এসে লকুলা থেকে প্লেনে
কাঠমাণ্ডুতে আসতে হবে, এখানে আবহাওয়া খারাপ থাকলে কাঠমাণ্ডুতে আসা দেরি হতে
পারে।
নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার অধ্যাপক নিম চন্দ্র
ভৌমিক জানিয়েছেন, নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাস সংবর্ধনা দেবে এভারেস্ট জয়ী
বাংলাদেশের প্রথম নারী নিশাত মজুমদার এবং দ্বিতীয়বার এভারেস্ট জয়ী এমএ
মুহিতকে। ২৮শে মে তাদের কাঠমাণ্ডুতে ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে। ২৮শে মে তারা
ফিরলে ওই দিনই দূতাবাস তাদের সংবর্ধনা দেবে।
বাংলাদেশ থেকে নেপালে
যাচ্ছে আগ্রহীরা। জানা গেছে, নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে নিশাত-মুহিতকে
সংবর্ধনা জানানোর জন্য নেপালে যাচ্ছে বাংলাদেশের অনেক আগ্রহী। এখন পর্যন্ত
জানা গেছে, দ্বিতীয়বার এভারেস্ট বিজয়ী এমএ মুহিতের বোন সাংবাদিক বেবী
যাচ্ছেন কাঠমাণ্ডুতে ভাইকে রিসিভ করতে, আরও যাচ্ছেন নিশাত ও মুহিতের হিমালয়
অভিযানের স্পন্সর প্রতিষ্ঠান প্যারাগন গ্রুপের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান এবং
সুইস বেকারির স্বত্বাধিকারী উলফত কাদের।
No comments:
Post a Comment