Sunday, July 8, 2012

সেনা অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা নাকচ দ্রুত নির্বাচনী চুক্তি প্রয়োজন


Source: The daily Manabzamin, 08-07-12
 ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার একটি ভাষণ ওয়াশিংটন শুধু নয়, ওয়েব বার্তার কারণে বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে। স্থান: ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী থিংক ট্যাঙ্ক হেরিটেজ ফাউন্ডেশন। তারিখ ২১শে জুন ২০১২। ৪৫ মিনিটের দীর্ঘ ভাষণে ড্যান ডব্লিউ মজিনা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র  সম্পর্ক, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, ভবিষ্যৎ নির্বাচন, হিলারি ক্লিনটনের সামপ্রতিক ঢাকা সফর, সিভিল সোসাইটির ভূমিকা, ইলিয়াস আলী গুম, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডসহ নানা বিষয়ে মতামত তুলে ধরেন। গ্রামীণব্যাংক প্রসঙ্গ তো ছিলই। মজিনা বলেন, তার ধারণা, বাংলাদেশে আর সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করবে না। ঢাকা সফরকালে হিলারি ক্লিনটন নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনটি শব্দ একাধিকবার উচ্চারণ করেন। শব্দ তিনটি হচ্ছে- প্ল্যান, গ্রাউন্ড রুলস এবং মেকানিজম। পুরো বক্তৃতাটি আমাদের কাছে এসেছে। পরখ করে দেখা যেতে পারে কি ছিল তার ওই আলোচিত বক্তৃতায়।


আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করছি। আমি বাংলাদেশে মাঝেমধ্যেই বাইসাইকেল চালাই। এখানকার আকাশ খোলা। উদাস করে কাছে ডাকে। এটাই হয়তো ঠিক। তাই যে কোন ভাবেই হোক বাইসাইকেল চালাই আমি। কয়েক সপ্তাহ আগে আমি বাইসাইকেল চালিয়েছি প্যারিসে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ সফর করেছেন। তিনি এসেছিলেন মে মাসের শুরুর দিকে। তখন আমার এক বন্ধু জানতে চেয়েছিলেন হিলারি কেন বাংলাদেশে এসেছেন। তখন আমি কৌতুক করেছিলাম। শুধু হেসেছি। কোন উত্তর দিইনি। কিন্তু আমার বন্ধু খুব সিরিয়াস ছিলেন। পরে আমি তাকে তার প্রশ্নের জবাব দিয়েছি।


হিলারি বাংলাদেশে এসেছিলেন। কারণ, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান, কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কেন? তা ব্যাখ্যা করছি। বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ। বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম দেশ। এটা একটি ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক, গণতান্ত্রিক, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। নেপাল, ভারত, চীন, মিয়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছে। এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতার উন্নতির জন্য তা খুবই জরুরি। এটাই আমেরিকার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন অ্যাঙ্গোলা গিয়েছিলেন, তখন আমি সেখানে রাষ্ট্রদূত ছিলাম। তখন আমাদের মধ্যে অনেক বিষয়ে কথা হয়েছিল। আমরা আলাপ করেছিলাম- আমাদের জীবনেই বিশ্বের জনসংখ্যা ৯০০ কোটি দাঁড়াবে। আমার মনে পড়ে, গত সেপ্টেম্বরেই তা হয়তো ৭০০ কোটি ছিল। তখন হিলারি বলেছিলেন- ওই সব বর্ধিত মানুষের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। তাই বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশকে তার বাড়তি মানুষের খাদ্য যোগানের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ মানুষ বাড়বে তাদের খাদ্যের নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতেই হবে। গড়ে তুলতে হবে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা। যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের আগ্রহ। গত বছর আমরা প্রায় ১০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছি বাংলাদেশে। আগের বছরের তুলনায় এ পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ৮ থেকে ১০ হাজার চাকরি সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। এটাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বের বিষয়। তৈরী পোশাকের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে দুই নম্বর দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশে আমরা সবচেয়ে বেশি অর্থের বিনিয়োগকারী। এদেশে আমাদের মূল্যবান বেশ কিছু এজেন্ডা আছে। তার মধ্যে রয়েছে মানবাধিকারের প্রতি সমর্থন, গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন। রয়েছে মানবতা বিষয়ক এজেন্ডা। আমরা ৫৪৭টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ করেছি। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৩ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়ে জীবন রক্ষা করতে পারেন। আরও বেশ কিছু একই রকম প্রকল্পে আমরা সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাপ্রবণ দেশ। বিপর্যয়- ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা এখনও আঘাত হানে এদেশে। কিন্তু তাতে হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন এমন ঘটনা এখন আর ঘটে না। হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। আমরা বাংলাদেশীদের সঙ্গে কাজ করছি তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে। তারপরও কেন বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ? এর জবাব হলো- এখানে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, বৈশ্বিক শান্তি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, মানবতা বিষয়ক এজেন্ডা- এ সবই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ। আমরা এমন একটি বাংলাদেশকে সমর্থন করি, যে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ, উন্নত, গণতান্ত্রিক। শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ, সমৃদ্ধ, সুস্থ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পক্ষেই আমরা। কেন আমরা এমনটা করছি? এটা যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের বিষয়। যে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ, সমৃদ্ধ, সুস্থ সবল গণতন্ত্রের- তার অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দেয়। এটা বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বিজয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কেন বাংলাদেশে এসেছিলেন তার উত্তর হতে পারে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ একটি বন্ধু রাষ্ট্র। তারা যুক্তরাষ্ট্রের খুব ভাল বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্য দক্ষিণ এশিয়ায় এমন একজন বন্ধুর গুরুত্ব অনেক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এই বন্ধুত্বের কথা জানেন। তিনি জানেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদারিত্বের বিষয়টি। তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অগ্রগতি জানতে এসেছিলেন। এক সময় বাংলাদেশকে বলা হতো ‘পরবর্তী আফগানিস্তান’। আপনাদের অনেকেই সে কথা স্মরণ করতে পারেন। বলা হতো- বাংলাদেশ হতে চলেছে পরবর্তী আফগানিস্তান। এটাই আমাদের কাছে প্রশ্ন। এ প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব হচ্ছে- না। কারণ, বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে উন্নতি করেছে, এটাই বন্ধুত্বের সূত্র। বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাদের সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত। বাংলাদেশকে সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা করতে সেনাবাহিনী থেকে সেনাবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে হবে। আমরা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাকে নিরাপদ দেখতে চাই। আমরা কাজ করছি গভীরভাবে। বাংলাদেশকে সন্ত্রাস থেকে রক্ষা করতে চাই। এতে শুধু বাংলাদেশীরাই লাভবান হবেন না। আমরাও লাভবান হবো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। আমরা শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশের পক্ষে। এদেশে কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে মাতৃমৃত্যুর হার। এক্ষেত্রে আমরা তাদের সহযোগী। বাংলাদেশ সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্র পূরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশের সহযোগী। বাংলাদেশের প্রজনন হার ৬.৩ থেকে ২.৩ ভাগে কমিয়ে আনা হয়েছে গত ৪০ বছরে। আমাদের সহযোগিতার এগুলোই হলো বড় অর্জন। আপনারা এই অর্জন দেখে গর্বিত হবেন। আমিও এতে গর্বিত। হিলারি ক্লিনটন অংশীদারিত্বকে সেলিব্রেট করতে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এসব বিষয়ে বলেছেন। তাই তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে সই করেছেন পার্টনারশিপ ডায়ালগ এগ্রিমেন্ট। এর মাধ্যমে আমাদের অংশীদারিত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। এর অধীনে প্রতি বছর উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে আমাদের অংশীদারিত্বের পর্যালোচনা হবে। এর প্রথম দফা অনুষ্ঠিত হবে সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে। এতে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তিনজন উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি। এর মধ্যে রয়েছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি। এটা আমাদের বড় অর্জন। বন্ধুরা তো একে অন্যের সঙ্গে মুক্তমনে কথা বলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি গার্মেন্ট শ্রমিক আমিনুল ইসলামের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। এটা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক পরিচিত নাম নয়। তিনি শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারের আন্দোলন করতেন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। এফএসিআইও সমর্থিত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মদতপুষ্ট গার্মেন্ট শ্রমিক সংগঠনের আন্দোলন করতেন তিনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে এপ্রিলের প্রথম দিকে। বাংলাদেশে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর এই সহিংসতা অপ্রত্যাশিত। হিলারি ক্লিনটন এই ইস্যুটি উত্থাপন করেছিলেন। তিনি মানবাধিকারের এই ইস্যুটি তুলেছিলেন। তিনি বিএনপি নেতা এম. ইলিয়াস আলীর নাম উল্লেখ করেছিলেন। সিলেট বিভাগের এই নেতা নিখোঁজ হয়েছেন প্রায় তিন মাস হতে চলেছে। নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। ঢাকা সফরে হিলারি বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনার গুরুত্বের কথা তুলে ধরেছিলেন। বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে, না হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু কিভাবে ওই নির্বাচন করা যাবে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন সংলাপ হয়নি। এই নির্বাচনের জন্য পরিকল্পনা করে বিভিন্ন নেতার মধ্যে গ্রাউন্ডওয়ার্ক ও কৌশল প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটন। তিনি টিকফা’র আহ্বান জানিয়েছেন। কি সুন্দর শুনতে লাগে এই শব্দটি। এর পুরো নাম ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট। এটা খুব সাধারণ একটি চুক্তি। এ নিয়ে চার বছর ধরে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এখনও তা আলোর মুখ দেখতে পায়নি। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের বাধা নিরূপণের কথা রয়েছে। পরামর্শের কথা রয়েছে। বাধা চিহ্নিত করার কথা রয়েছে। চার বছরেও কেন এ চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি? আমার বা আমেরিকার ধারণা, বাংলাদেশ কোন না কোনভাবে আন্তর্জাতিক শ্রম বিষয়ক প্রতিশ্রুতি থেকে পিছনে সরে আসার চেষ্টা করছে। এটা খুব ভাল খবর নয়। হিলারি এই ইস্যুটি তুলে ধরেছিলেন। তিনি সুশীল সমাজ সম্পর্কে কথা বলেছেন। সুশীল সমাজের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে। হিলারি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন। এ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। হিলারি এই ব্যাংকের অখণ্ডতার বিষয়েও কথা বলেছেন। কথা বলেছেন, এর সহযোগী কোম্পানিগুলোর বিষয়েও। এগুলোর মধ্যে ৫৪টি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্য দিয়ে চলছে। তাই হিলারির এই সফর খুব অর্থবহ। বাংলাদেশ তৈরী পোশাক, জুতা, চামড়াজাত পণ্য, মার্কিন বাজারে শুল্কের বিষয়টি তুলে ধরেছে। তারা এ খাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়েছে। হিলারি বলেছেন, এমন সব বিষয় আলোচনার জন্য টিকফা হতে পারে ভাল জায়গা। বাংলাদেশ মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জে অংশীদার হতে চায়। এটা শুরু হয়েছিল বিগত সরকারের সময়ে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে এ কাজগুলো করা হয়। এক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বা কোন মার্কিনি নির্ধারণ করেন না- বাংলাদেশের জন্য কিসে ভাল হবে। এক্ষেত্রে এ লক্ষ্য পূরণের জন্য বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে কাজ করতে পারে। তারা এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছে। ১৯৭৫ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দেশে ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। তাই হিলারির সফর নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ওই সফরের ওপর ভিত্তি করে আমরা এখন গঠনমূলক কাজ করছি। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তা করা হবে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ বজায় রেখে। আমি আগামী নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছি। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। এ ধারণাটাই তারা এতদিন ব্যবহার করেছে। এই ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতা থাকে না। তারা ক্ষমতা দিয়ে দেয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে। সেই ব্যবস্থার নাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয় সুপ্রিম কোর্টের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে নিয়ে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারই নির্বাচন পরিচালনা করে। তারা থাকে নিরপেক্ষ। কিন্তু এই ব্যবস্থাকে বাতিল করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো তারাও বলছে, তাদের অধীনেই নির্বাচন পরিচালনা করবে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। জবাবে বিরোধী দল বলছে- না। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার অবাধ, মুক্ত ও স্বাধীন নির্বাচন করবে এমনটা বিশ্বাস করে না তারা। এক্ষেত্রে হিলারি এবং আমি বলেছি- তাদেরকে এমন একটি পন্থা বের করতেই হবে যার অধীনে ওই নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। এখনকার দিনে এটাই সবচেয়ে বড় ইস্যু। এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে হরতাল, সংঘর্ষ। এতে বাংলাদেশের জনগণের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং বিনিয়োগ আকর্ষণেও তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক হতে হবে। বাংলাদেশের সংস্কৃতির রয়েছে ভীষণ গভীরতা এবং তা ভীষণ সমৃদ্ধ। এখন প্রশ্ন হলো- কখন ওই নির্বাচন হতে যাচ্ছে? গণতন্ত্রের ভাষায়- সময়মতো সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ নির্বাচন হতে হবে। তা করতে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্ধারণ করতে হবে কিভাবে তারা ওই নির্বাচন অনুষ্ঠান করবেন। তাই এ বিষয়ে তাদেরকে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো- তা কি ২০১২ সালে, ১০১৩ সালে, ২০২০ সালে? তা যদি হয় ২০১৭ সালে বা ২০২০ সালে তাহলে সেখানে সহিংসতা দেখা দেবে। অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। বাংলাদেশ নিয়ে আমার একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে। বাংলাদেশকে আমি দেখি পরবর্তী এশিয়ান টাইগার হিসেবে। আমি একে বলি বাংলার বাঘ (বেঙ্গল টাইগার)। তৈরী পোশাকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক। এক্ষেত্রে তারা চীনকে হটিয়ে দিয়েছে। ন্যাপকিন, কাপড়, তোয়ালে রপ্তানিতে চীনকে পিছনে ফেলে সবার সামনে চলে এসেছে। ফার্মাসিউটিক্যালস, পাট, আইটি সবক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মধ্য আয়ের বাংলাদেশ, গোল্ডেন বাংলাদেশ, বাংলার বাঘ তা বুঝতে পারছে না। তারা বুঝতে পারছে না বাংলাদেশ অনিশ্চয়তায় কুঁচকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রয়েছে অস্থিতিশীলতা। এ সবই হচ্ছে ওই নির্বাচনকে সামনে রেখে উদ্বেগের কারণ। আরও একটি হুমকি বাংলাদেশের সামনে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তৈরী পোশাকের বাজার আমেরিকা। এরই মধ্যে আমি আমিনুল ইসলামের বিষয় বলেছি। তাকে এপ্রিলে হত্যা করা হয়েছে। আমিনুল হত্যার এই বিষয়টি হিলারি আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। ৬ বছর আগে এফএসিআইও আবেদন করেছিল জিএসপি বাতিল করতে। এটি হলো জেনারেল সিস্টেম অব প্রিফেন্সেস। আমি টিকফা’র কথা বলেছি। বাংলাদেশ শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেয়ার আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এখন থেকে ৩ সপ্তাহ আগে এক রাতে আমি একটি ফোন পাই। ওই ফোনটি করেছিলেন বাংলাদেশী তৈরী পোশাকের আমেরিকান বায়ারের এক নির্বাহী অফিসার। তিনি তার কোম্পানির সুনাম নিয়ে ছিলেন হতাশ। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, আগুন, শ্রমিকের সঙ্কট এসব নিয়ে তার মাঝে উদ্বেগ। তিন দিন পরে আমি একটি পার্টিতে গিয়েছিলাম। এর আয়োজন করেছিলেন বাংলাদেশ চেম্বারস অ্যান্ড কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট। এটি বিভিন্ন রকম ৩৬টি সংগঠনের একটি সমন্বিত সংগঠন। সেখানে তিনি আমাকে বললেন, আপনার সঙ্গে কিছু লোক কথা বলতে চান। তিনি আমাকে এক পাশে নিয়ে গেলেন। সেখানে ৬ জন লোক এগিয়ে এলেন। তারা প্রত্যেকে যুক্তরাষ্ট্রের বায়ার কোম্পানির প্রতিনিধি। তারাও একই বার্তা দিলেন। তারাও কোম্পানির সুনাম নিয়ে উদ্বেগে। আমরা ক্লিন পোশাক পরতে চাই। আমরা ময়লা পোশাক পরতে চাই না। ময়লা পোশাক হলো সেগুলো, যেগুলো তৈরি করেন ওইসব শ্রমিক, যাদেরকে টার্গেট করা হয়েছে। এক্ষেত্রে হিলারি সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটি পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীকে। কম্বোডিয়ার উদাহরণের দিকে তাকান। কলম্বিয়ার উদাহরণের দিকে তাকান। দক্ষিণ আমেরিকায় সবচেয়ে দ্রুত উন্নতি অর্জন করা দেশ কলম্বিয়া। ৩ বা ৪ বছর আগেও এ দেশটি ছিল এর বিপরীতমুখী। কম্বোডিয়া তার তৈরী পোশাক নিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছে। কিভাবে? তারা আইএলও’র অধীনে কাজ করে। সেখানে সরকার, মালিক, শ্রমিক সবাই একে অন্যের বিরুদ্ধে কাজ না করে একত্রিত হয়ে কাজ করে। তারা একটি সুষ্ঠু বাণিজ্যের প্লাটফর্ম বানাতে এভাবে একত্রে কাজ করছে। বাংলাদেশকে এই আদর্শ গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন হিলারি। তবে এক্ষেত্রে আইএলও’ও তাদের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে খুব ধীর গতিতে।


টেকনোলজি খাতে বিনিয়োগ করা সরকারের কাজ নয়। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ করবেন বিনিয়োগকারীরা, ব্যবসায়ীরা। আমাকে বলা হয় আপনি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশের রাষ্ট্রদূত। আপনাকে অবশ্যই বাংলাদেশে টেকনোলজি আনতে হবে। আমি জবাবে বলি- না। বিনিয়োগকারীরা টেকনোলজি আনবেন। আমাকে বলা হয়, আপনাকে বিনিয়োগকারী আনতেই হবে। আমি বলি- না। আমি বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশী বন্ধুদের বলবো- সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই প্রয়োজন। তা নিশ্চিত করতে পারলেই বাংলাদেশে অধিক সংখ্যক বিনিয়োগকারী আসবেন। বেঙ্গল টারগারদের কর্মক্ষমতা অনেক বেশি। সেখানে বিনিয়োগ না হলে এই কর্মক্ষমতা বোঝা কষ্ট। সেই বিনিয়োগের জন্য সেখানে রাজনৈতিক পরিবেশ, স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। প্রয়োজন বন্দর, সড়ক, বিমানপথ, বিদ্যুৎ, দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ, আইনের শাসন- তাহলেই বিনিয়োগ বাড়বে। এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব। যখন এসব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, তখনই বাংলাদেশ বিদেশী বিনিয়োগ প্রবল বেগে ধাবমান হবে। এর সঙ্গে আসবে টেকনোলজি। বাংলাদেশে রয়েছে অভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা আর মানুষগুলো উদ্যমী, সৃষ্টিশীল, গতিময়। এটাই হলো বাংলাদেশের শক্তি। এসব সমস্যা মোকাবিলা করতে পারলে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ শিগগিরই হতে পারবে এশিয়ান টাইগার। বাংলাদেশের যুব সমাজের অনেকে বিদেশে পড়াশোনা করে দেশে ফিরছে। তারা দেশে কাজ করছেন।


ভারত প্রসঙ্গ
ভারত প্রসঙ্গ একটি মিশ্র বিষয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অম্লমধুর। এই সরকার ভারতের কাছে পৌঁছতে পেরেছে। সন্ত্রাস দমনের মাধ্যমে তা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতকে কট্টরপন্থি সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে। এক্ষেত্রে সফলতা আসছেই। এটা একটি বড় অর্জন। এশিয়ার সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোলে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ৫ বা ৬ মাস আগে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হওয়ার পর বাণিজ্য দ্বিগুণ হয়েছে। দিনে ২০০ থেকে ৪০০ ট্রাক যাতায়াত করে এ বন্দর দিয়ে। এটা একটা বাস্তব পরিবর্তন। পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চুক্তি অনুমোদন করেছে। কিন্তু তাতে প্রভাব পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকার বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দ্বিমত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমোদন না মিললে এ চুক্তি বাস্তবায়ন করা যাবে না। অনেকেই আশা করেন এ চুক্তির জটিলতা কেটে যাবে। ভারত তার সেভেন সিস্টারের কাছে মালামাল সহজে পৌঁছাতে চায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তারা ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। আমি আশা করি এ বিষয়টিও সহসাই নিষ্পত্তি হবে। এ ট্রানজিট চালু হলে সবাই উপকৃত হবেন। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হয়েছে। নৌ-সীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। এর ফলে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। তবে রোহিঙ্গারা বাংলাভাষী। তাদেরকে মিয়ামনারের নাগরিকরা বার্মিজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তাদের কয়েক হাজার এর আগেই শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। সেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে চেষ্টা করে। এটা একটি বড় সমস্যা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা মেনে নেয়া উচিত।


সেনাবাহিনী প্রসঙ্গ
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ক্ষমতার নেপথ্যে ছিল সেনাবাহিনী। তারা সফল হয়েছে। দেশের জন্য ভাল হয়েছে। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের আর কোন সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। আমি সেনাবাহিনীর প্রায় সব শাখার কর্মকর্তাদের চিনি। আমি দেখি না সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনী হিসেবে ক্ষমতা দখল করছে। কিন্তু বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ খুব জরুরি। তারা একে অন্যকে চেনেন। তারা একে অন্যের আত্মীয়। একের মোবাইলে আরেকজনের ফোন যায়। তারা আলোচনায় বসবেন বলে আমি আশাবাদী। আলামত দেখতে পাচ্ছি। আমি আশাবাদী, তারাই কৌশল বের করবেন কিভাবে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা যায়। আজ হোক কাল হোক এ বিষয়ে একটি সমঝোতা হবে বলে আমি আশাবাদী। আমি মনে করি তারা এরই মধ্যে আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন।

No comments:

Post a Comment