আল জাজিরার রিপোর্ট: তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বাংলাদেশে অচলাবস্থা
আগামী নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে অচলাবস্থা
দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক তিক্ততায় সৃষ্টি হয়েছে গোলমেলে পরিস্থিতি। গতকাল
অনলাইন আল জাজিরায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ রিলস ফ্রম পলিটিক্যাল বিকারিং’
শীর্ষক রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, ধর্মঘট ও রাজপথে কখনও তা
সহিংস রূপ পাওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার রাজনৈতিক অচলাবস্থা মীমাংসার দিকে
তাকিয়ে আছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা
বলছে, আগামী বছরের শেষের দিকে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগেই সরকারকে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। যতদিন তা না হবে
ততদিন তারা রাজপথ ছাড়বেন না। কিন্তু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার
তা মেনে না নিতে বদ্ধপরিকর। তারা পিছু হটবেন না। বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানী
গোলাম সারওয়ার খান বলেছেন, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী জোট একে অন্যকে ঘায়েল
করছে। এতে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা ব্যবসা থেকে শুরু করে সামাজিক
শৃঙ্খলা সব কিছুকেই প্রভাবিত করছে। সিনিয়র এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন,
বর্তমানে রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা শোচনীয় পরিণতি বয়ে আনতে
পারে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক এই অচলাবস্থার যদি অবসান না হয় তাহলে সামনে
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়তে পারে। ঘটতে পারে ব্যাপক সহিংসতা। বাংলাদেশে
এসব ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটছে যখন দেশের অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী। নারীর
ক্ষমতায়ন, জনস্বাস্থ্য ও দারিদ্র্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রশংসা
করা হয়েছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ
এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার পর ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে নির্বাচনী
গণতন্ত্র ফিরে আসে। তখন থেকেই অন্তর্বর্তী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
অধীনে নির্বাচনে একবার বিএনপি, একবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু
২০০৬ সালে বিএনপি সরকার যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়
তারা দু’বছরেরও বেশি সময় নির্বাচন দিতে পারে নি। বিশ্লেষক সব্যসাচী বসুরায়
চৌধুরী ব্যাখ্যা করেন, বিএনপি ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
ক্ষমতায় আসে তাতে ছিল সেনাবাহিনীর প্রভাব। তারা দেশ থেকে দুর্নীতিমুক্ত
করতে থাকেন। তখন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের দুর্নীতির অভিযোগে
আটক করে জেলে দেয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের জন্য, কিন্তু তারা
পরিষ্কারভাবে তাদের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এই সরকারের
অধীনে নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় পায় আওয়ামী লীগ। তার কিছু পরে বাংলাদেশ
সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করে। তবে তারা রায়ে এ-ও
বলেন যে, আগামী দু’টি পার্লামেন্ট নির্বাচন এ ব্যবস্থার অধীনে করা যেতে
পারে। আওয়ামী লীগ আদালতের রায় মেনে নেয়। তারা পার্লামেন্টে সংবিধানের ১৫তম
সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এ ঘটনা ঘটে গত
বছরের জুন মাসে। ওই সংশোধনী ২৯৭-১ ভোটে পাস হয়। তবে ভোট দেয়া থেকে বিরত
থাকেন বিএনপির সদস্যরা। প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, গত বছর থেকেই তিনি বলে আসছেন আওয়ামী লীগ
জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে তারা দেশকে
একদলীয় শাসন কায়েমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা
ভেঙে দিয়ে সমঝোতার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আমাদের রাজপথে বিক্ষোভ করা
ছাড়া কোন বিকল্প নেই। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু
হবে না। খালেদা জিয়া গত সপ্তাহে এমন এক সময়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা
বলেন যখন তার দলীয় সমর্থকরা রাজপথে ধর্মঘট ও সড়ক অবরোধ করেছিল। জেলে ঢোকানো
হয়েছে তাদের কয়েক শ’ সমর্থককে। তাদের বিরুদ্ধে ভাঙচুর, সহিংসতা ও
অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধীদলীয় জোট শুধু
বিক্ষোভ দেখানোর মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি। পাশাপাশি তারা
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা না দিলে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার ঘোষণা
দিয়েছে। বিএনপির মুখপাত্র তরিকুল ইসলাম বলেন, সরকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ,
জনমানুষের মুক্তভাবে ভোট দেয়ার অধিকারকে নষ্ট করেছে। তাই গণতন্ত্রের জন্য
সংগ্রাম ছাড়া আমাদের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু কোনভাবেই তত্ত্বাবধায়ক
ব্যবস্থায় ফিরে না যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আওয়ামী লীগ। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক
প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে
গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের নির্বাচন যদি ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে হতে পারে এবং
এখনও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে পারে তাহলে বাংলাদেশে কেন তা
ঘটতে পারবে না? আওয়ামী লীগ অভিযোগ করছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সহ
ইসলামপন্থি জোট যুদ্ধাপরাধের বিচার বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছে। এই বিচারের
মুখোমুখি হচ্ছে তাদের বেশ কয়েকজন নেতা। তাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা
যুদ্ধের সময় গণহত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত করার অভিযোগ আছে।
বর্তমান ও সাবেক প্রধান সহ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ ৯ নেতা বিচারের
মুখোমুখি। এ জন্য দু’টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ বলে, ১৯৭১
সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ৫ লাখ নারীর
সম্ভ্রমহানি করা হয়েছে। তাজুল ইসলাম বলেন, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের
স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। তারা সর্বান্তঃকরণে সমর্থন দিয়েছে
পাকিস্তানি সেনাদের। ওই সময় পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছে বিএনপির কয়েকজন
নেতা। যুদ্ধাপরাধ আদালত তাদেরকে চিহ্নিত করেছে। এতে তারা বেপরোয়া হয়ে
পড়েছে। জবাবে বিএনপি নিজেকে জামায়াতে ইসলামী থেকে দূরে দূরে রাখছে। এরাই
ছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে জোট সরকারে। তবে বিএনপি যুদ্ধাপরাধ আদালতে বিচারের
বিরোধিতা করছে না। তাদের দাবি সুষ্ঠু বিচার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা বলেছেন, তার সরকার কোন সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা সহ্য করবে না। তার
মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন,
বিএনপি দেশকে নিয়ে যাচ্ছে গৃহযুদ্ধের দিকে। জনগণ তাদের ক্ষমা করবে না।
তাদের উচিত সংসদে যোগ দেয়া এবং নির্বাচনে শান্তিপূর্ণভাবে অংশ নেয়া। কিন্তু
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হলে বিএনপি ও বিরোধী অন্য দলগুলো
নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলছে। ফলে দেশ একটি রাজনৈতিক অচলাবস্থার দিকে
যাচ্ছে বলে দৃশ্যত মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে
মধ্যস্থতা করেন ব্যবসায়ী নেতারা। কিন্তু এবার রাজনৈতিক নেতারা ব্যবসায়ীদের
সে পথে বাধা দিয়েছেন। হরতাল ও রাজপথের সহিংসতায় কারখানায় উৎপাদন, রপ্তানি,
বিদেশী বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে বাণিজ্যিক খাত হতাশ হয়ে পড়েছে।
এফবিসিসিআই’র চেয়ারম্যান কাজী আকরামুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ব্যবসার জন্য এই
অবস্থা নেতিবাচক। অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক। এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য
আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই একটি সমাধানের পথ বের করতে হবে। ওই
রিপোর্টে আরও বলা হয়, বিদেশীরা বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান টেক্সটাইল কারখানা,
বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অন্যান্য অবকাঠামোতে যখন বিনিয়োগ করার সুযোগ খুঁজছে তখন
এই রাজনৈতিক টানাপড়েনে তারা ফিরে যাচ্ছে। এ বছরে বাংলাদেশের টাকার মান
যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে শতকরা ৫ ভাগ বেড়েছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের
রপ্তানি আয় বেড়েছে শতকরা ৪০ ভাগ। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিষয়ে বেশ কয়েকটি
সুলক্ষণ আছে। তাহলো প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্স ১৪০০ কোটি ডলার
ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঢাকায় একটি পাতাল রেলে বিনিয়োগ করতে
জাপানিরা মুখিয়ে আছে। কিছু দুর্নীতি চিহ্নিত করে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে
তহবিল দেয়া স্থগিত রেখেছে। এ নিয়ে দর কষাকষি চলছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল
আবদুল মুহিত বলেছেন, এসবের সময় নয় এখন। যারা এগুলো করছে তারা দেশ ও
উন্নয়নের শত্রু।
No comments:
Post a Comment