Tuesday, March 27, 2012

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট-২০১১

সংসদে ব্যাপক ম্যান্ডেট ব্যবহার করে ২০১১ সালে মানবাধিকার জোরালোভাবে রক্ষা করতে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ হয়েছে। র‌্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর যেসব সদস্য বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের বিচার করার পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলছেন, ওই রকম কোন সহিংসতা ঘটেনি। এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তে এক্ষেত্রে যে ভুল হয়েছে তার প্রমাণ মিলেছে। নির্যাতনের নতুন নতুন অভিযোগ, খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার এবং পুলিশের হাতে অব্যাহতভাবে গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। ২২শে জানুয়ারি বাংলাদেশে ২০১১ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে এক রিপোর্টে এ কথা বলেছে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সারাবিশ্বের ওপর ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে বাংলাদেশ অধ্যায়ের নামÑ ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২০১২: বাংলাদেশ। পরের দিন ২৩শে জানুয়ারি ২০১২ সালে এ বিষয়ে দৈনিক মানবজমিন সহ প্রায় সব পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের বিচার করার মাধ্যমে সরকার সুশীল সমাজ বিষয়ক সংগঠনের ওপর নিয়ন্ত্রণ কড়াকড়ি করেছে। বেসরকারি সংগঠন এনজিওগুলোতে বিদেশী সহায়তা বিলম্বিত করে সেখানে নিয়ন্ত্রণ কড়াকড়ি করা হয়। এ অবস্থায় মিডিয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের একটি বিল প্রস্তাব করা হয়, যাতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বক্তৃতা সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়। বিলটি বিবেচনাধীন ছিল। নারীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, যৌতুক বিষয়ক হয়রানি, এসিড নিক্ষেপ এবং যৌন হয়রানির ঘটনা অব্যাহত ছিল।
ওই রিপোর্টে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও অন্যান্য নির্যাতন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। বলা হয়, খেয়ালখুশিমতো মানুষ গ্রেপ্তার, মাঝেমধ্যে নির্যাতন এবং নিরাপত্তা হেফাজতে হত্যার শক্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এর জন্য জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অস্বীকার করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের যথাযথ তদন্ত করে তাদের বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১১ সালের ২১শে মে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের একজন প্রতিনিধি উইলিয়াম গোমেজকে সাদা পোশাকধারী র‌্যাবের সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। তাকে ‘সদরদপ্তরে’ নিয়ে যাওয়া হয়। অভিযোগ আছে, সেখানে তাকে নগ্ন করা হয়। হাত ও পা বেঁধে ফেলা হয়। কষ্টদায়ক ওই পরিস্থিতিতে তাকে থাকতে বাধ্য করা হয়। এ সময়ে তাকে গালিগালাজ করা হয়। শারীরিক নির্যাতন করা হয়। মানবাধিকার লংঘন নিয়ে তার প্রামাণ্য কাজের বিষয়ে তকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয। কমপক্ষে দুটি ক্ষেত্রে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার নিজস্ব তদন্ত রিপোর্ট অস্বীকার করেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিলÑ র‌্যাব অনুচিত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অধিকার-এর মতে, ২০০৪ সাল থেকে কমপক্ষে ১৬০০ মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে, এর নেতারা অভিযোগ করেছিলেনÑ র‌্যাব ব্যাপকহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। তারা এখন দাবি করে, অপরাধীদের সঙ্গে গুলি বিনিময়কালে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। দেশের এবং আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে সেনা সদস্য ও পুলিশ নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা অথবা সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে মর্যাদাহানীকর শাস্তি দিয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তা হেফাজতে অনেক মৃত্যুর তদন্ত কখনও হয়নি। অধিকারের মতে, ২০১১ সালে পুলিশি নির্যাতনে কমপক্ষে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্রোহের সময় বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর), যা এখন বিজিবি, এর জড়িত অভিযুক্তদের সামরিক আদালতে শুনানি অব্যাহত ছিল ২০১১ সালে। ওই রিপোর্টে বলা হয়, সামরিক ওই আদালত প্রায় ১০০০ সদস্যকে অভিযুক্ত করেছে। ওই আদালতে বিচারের মান বজায় থাকেনি। কারণ, প্রতিজন আটক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ হাজির করা যায় নি। একটি বিচার শেষ হয়েছে ২৭শে জুন। ওই বিচারে অভিযুক্ত ৬৬৬ জনের মধ্যে ৬৫৭ জনকে দোষী পাওয়া যায়। তাদেরকে চার মাস থেকে সাত বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। আরও কয়েক হাজার সদস্যের বিচার হচ্ছে সামরিক আদালতে। তাদেরকে রাখা হয়েছে নিরাপত্তা হেফাজতে। অন্য ৮৪৭ জনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের কারো কারো দণ্ডবিধি অনুযায়ী মৃত্যৃদণ্ড হতে পারে। তাদের অনেকের পক্ষে কোন আইনজীবী নেই। বিদ্রোহের পর তদন্তকালে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা প্রায় ৭০ জন মারা যান। অভিযোগ আছে তারা নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে তদন্ত করেনি। অনেক সন্দেহভাজনকে আইনী পরামর্শ পাওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয় সরকার মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অধিকার ও বিশেষ করে অধিকারের সেক্রেটারি এডভোকেট আদিলুর রহমান খানের ওপর সরকার নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। সরকার তাদেরকে হুমকি দিচ্ছে। স্টাফদের হয়রানি করছে এবং প্রকল্প অনুমোদন পেতে বিলম্ব করানো হচ্ছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. মুহাম্মদের অবসরের বয়স পাড় হয়ে যাওয়ার কারণে সরকার তাকে তার গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেয়। তার সমর্থকদের ওপরও রহস্যজনক হামলা হয়। ২০১১ সালের মে মাসে গ্রামীণ ব্যাংকের একাউন্টস অফিসার সগিরুর রশিদ চৌধুরীকে সাদা পোশাক পরা লোকজন অফিসের বাইরে তুলে নিয়ে যায়। যখন তাকে ছেড়ে দেয়া হয় তখন তার শরীরে প্রহারের মারাত্মক চিহ্ন। তিনি তখন বলেন, তাকে যারা অপহরণ করেছিল তারা তাকে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে একটি বিবৃতি দিতে বলে। সেপ্টেম্বরে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের ৬ জন নারী পরিচালক ও একজন সাবেক পরিচালককে পুলিশ ভয় দেখায়। তারা তাদের রুমে গিয়ে তা তল্লাশি করতে থাকে। সরকার বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটি নামের একটি ট্রেড ইউনিয়ন (বিসিডব্লিউএস) গ্রুপকে ভীতি দেখাতে আইনি ব্যবস্থা অব্যাহত রাখে। সরকার বিসিডব্লিউএস-এর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার পর একটি এজেন্সি দাবি করে যে, দুই ইউনিয়ন নেতা কল্পনা আখতার ও বাবুল আখতার ওই সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন নবায়নের পূর্বশর্ত হিসেবে পদত্যাগ করেন। তাদের দু’জনেই অপরাধ বিষয়ক অভিযোগ মোকাবিলা করছিলেন। তবে বিসিডব্লিউএস সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, সুষ্ঠু বিচারের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালের জুনে ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবুন্যালস) এক্ট সংশোধন করে। এতে অভিযুক্তকে নিরাপরাধ দাবির অধিকার, সুষ্ঠু ও প্রকাশ্য শুনানির কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৃশংসতার জন্য দায়ীদের বিচারের জন্য এই আইন করা হলেও এখনও তা আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। ফলে সরকার আইনটি সংশোধন করে বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিবাদী পক্ষের আইনজীবী, সাক্ষী ও তদন্তকারীদের হুমকি দেয়া হয় বলে দাবি করেন তারা। এই আদালত ২০১১ সালে প্রথম মামলার বিচার কাজ শুরু করে। এ মামলাটি জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিলেন। ওই রিপোর্টে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নারী অধিকার নিয়েও কথা বলেছে। এতে বলা হয়েছে, নারী ও কন্যা শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বিরোধী আইন রয়েছে। কিন্তু ২০১১ সালে নারী বা যুবতী মেয়েদের বিরুদ্ধে প্রহার, নিসঙ্গ করে রাখা এবঙ অন্যান্য অবমাননা করার মতো নতুন নতুন খবর মিলেছে। এসব কিছু চাপিয়ে দিয়েছে ধর্মীয় নেতারা ফতোয়ার নামে। পুরুষের সঙ্গে কথা বলা, বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ক, বিয়ের বাইরে সন্তান জন্ম দেয়া এবং ব্যাভিচারিতার জন্য এই সব ফতোয়া দেয়া হজয়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের মাধ্যমে সরকারকে এসব বিষয়ে প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থা ও বিচারের নির্দেশ দিলেও নারী অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে এমন নির্যাতন চলছিলই।  বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ২০১১ সালে আভ্যন্তরীণ সহিংসতা বিরোধী একটি আইন করে। নারীদের অধিকার এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ সরকার একটি জাতীয় নীতি চালু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যেরে নিয়োগকারীরা সেখানে গৃহকর্মের জন্য নারীদের নিয়োগ দিতে বাংলাদেশের দিকে বেশি বেশি ঝুঁকছে। তবে অন্য যেসব দেশ শ্রমিক পাঠায় ব্যাপক শোষনের কারণে তারা তাদের নিয়মকানুন কড়াকড়ি করেছে না হয় কর্মী পাঠানো নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ সরকার ওইসব নারী শ্রমিকদের প্রশিক্ষণকালীন বা নিয়োগকালীন নিম্নতম নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।  অথবা বিদেশে দূতাবাসে শ্রম বিষয়ক অ্যাটাচেতে পর্যাপ্ত লোকবল নিশ্চিত করা হয়নি। নির্যাতিতার আশ্রয় বা এ সংক্রান্ত ঘটনায় তাদের পক্ষ নেয়ারও লোক নেই। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার ওই রিপোর্টে আরও বলে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও অবমাননার ঠেকাতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ খুব সামান্যই করেছে। নৃগোষ্ঠী, আদিবাসী সংখ্যালঘু গ্রুপ ও পুনর্বাসিত বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যে বার বার সংঘর্ষ হয়েছে। আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা করতে সরকার যে চুক্তি করেছিল তা বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কারণে এই সংঘাত ঘটেছে।
ওই রিপোর্টে বলা হয়, ২০১১ সালে র‌্যাব কর্তৃক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় তারা দায়মুক্তি পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এই দুই দেশই র‌্যাবকে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। যুক্তরাজ্য ২০১১ সালে ওই কর্মসূচী শেষ করে। নির্যাতন,  গুম ও র‌্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি নিরপেক্ষ ইউনিট গঠন করার সুপারিশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।  ২০১১ সালে বাংলাদেশ এবং ভারত বাণিজ্য ও নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করলেও কোন বাংলাদেশী নাগরিকের প্রতি একশনে না যেতে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের নির্দেশ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত সরকার। কিন্তু তা তা সত্ত্বেও যারা নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তারা উপযুক্ত তদন্ত ও তাদের বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে।

No comments:

Post a Comment