Monday, December 28, 2015

ভারতের গরু-নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ


এস এন এম আবদি: বিদেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কূটনীতিক ও স্বাগতিক দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে যে কথোপকথন হয় তা সাধারণত গোপনীয়তায় মোড়া থাকে। কিন্তু ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সম্প্রতি নয়া দিল্লিতে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ একজন দূতের সঙ্গে কি কথা হয়েছে তা প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের বাইরে থাকলে এই রাজনাথ সিং ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তো তিনি তার সংসদীয় আসন লক্ষেèৗতে এক জনসভায় জোর দিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশী হাই কমিশনার মুয়াজ্জেম আলী আমাকে বলেছেন যে, তার দেশে গরুর মাংসের দাম অনেক বেড়ে গেছে’। এ কথা প্রকাশ করে তিনি যেন গর্বে ফেটে পড়ছিলেন। তার ভাবখানা এমন ছিল যে তিনি নিজেই নিজেকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। ভাবটা এমন যে, যদি তিনি পারতেন তাহলে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াতেন।
বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে মুয়াজ্জেম আলীর উদ্বেগের বিষয়টি প্রকাশের পর মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী রাজনাথ সিং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ভারতীয় গরু রপ্তানি দমন করার জন্য ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। এই বাহিনী সরাসরি তার নিয়ন্ত্রণে। রাজনাথ সিং জানান যে, যেখানে বছরে ২০ থেকে ২২ লাখ গরু সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকে সেখানে ২০১৫ সালে মাত্র ২ লাখ থেকে আড়াই লাখ গরু গিয়েছে বাংলাদেশে। এর ফলে সেখানে গরুর মাংসের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বাংলাদেশে গরুর মাংস বন্ধের বিতর্কিত উদ্যোগ নিয়েছে। সেই ধারাকে যেন আরেকটু এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন রাজনাথ সিং। যখনই তিনি ভারতের উদ্বৃত্ত গরু, দুধ উৎপাদনে অক্ষম এমন গরু বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী দেশে বন্ধের সিন্দান্ত নিয়েছেন তখন এ দেশে হিন্দুত্ববাদী এ আচরণের জন্য ভারত বিরোধিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ খাতে বছরে অনানুষ্ঠানিক এই বাণিজ্যে আয় হয় ১০০ কোটি ডলার। তা বন্ধ হয়ে আছে। অনেকদিন আগে থেকে এ ধারা চলছে। কত আগে থেকে চলছে তা কেউ স্মরণও করতে পারেন না।
এটা বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে, গত মাসে ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব মোজাম্মেল হক খান ও রাজিব মেহর্ষির মধ্যে দু’দিনের বৈঠক হয়েছে। তাতে বিজেপির এই গরু নিয়ে বাড়াবাড়ির বিষয়টি ছায়া ফেলেছে। জঙ্গি বিষয়েক গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, অনুপ্রবেশ, ভুয়া মুদ্রার বিস্তারে মতো ইস্যুর পরিবর্তে বিএসএফ গরু পাচার বন্ধ করা নিয়ে বেশি সময় ও শক্তি ব্যয় করা হয়েছে। আগেভাগে এসব বিষয়কে শীর্ষ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল।
ভারতীয় এক কর্মকর্তা স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ প্রধানত যে ইস্যু তুলে ধরেছে তা হলো বিএসএফের দমননীতি, যাতে বাংলাদেশে গরু সরবরাহ শতকরা ৭০ ভাগ কমে গেছে। এতে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বিফ ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাজনাথ সিং হিন্দুত্ববাদী দমননীতিকে উস্কে দেয়ার আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি চারটি গরু জবাই করা হলে তার মধ্যে ভারতীয় গরু থাকতো তিনটি। কারণ, তখন ভারতে চাহিদা পূরণের অতিরিক্ত গরু, দুধ উৎপাদনে গরুর ওপর দু’দেশের প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার সীমান্তে কোন বিধিনিষেধ ছিল না। বিজেপি সরকারের গরু-পন্থি ও গরুর মাংস বিরোধী এজেন্ডার মূল নিহিত আছে নরেন্দ্র মোদির ২০১২ সালের ৯ই আগস্টের ‘পিংক রেভ্যুলুশন’ বা গোলাপী বিপ্লবের মধ্যে। এটা তার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল। এরপর ২০১৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর আরএসএস প্রধান মোহন ভগত গরু রক্ষার ডাক দেন, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের ঘোষণা দেন, ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালু করেন, ধারা ৩৭০ বাতিল করান, এর ফলে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ সুগম হয়। আরও সত্য কথা হলো, ২০১৪ সালে বিজেপির নির্বাচনী মেনিফেস্টোর ৪১ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, তাদের সরকার গরু রক্ষা, উন্নয়ন ও এর বংশ রক্ষা করবে।
কিন্তু গরুর ওপর অবরোধ আরোপ করায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। এ সঙ্কট নিয়ে বাংলাদেশের একটি ইংরেজি দৈনিক তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রকাশ করে। এতে ভারতের স্বেচ্ছাচারিতায় ক্ষোভ ফুটে ওঠে। ভারতপন্থি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম অন রেকর্ডে বলেছেন, ভারতের দমননীতির কারণে বাংলাদেশের মাংস বাণিজ্য ও চামড়া শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে- এতে কোনই সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের মাংস প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট, কসাইখানা, ট্যানারি ও হাড় গুঁড়াকরণ কারখানাগুলো ভারতীয় গরুর ওপর নির্ভর করে চলে।
বাংলাদেশের মাংস রপ্তানিকারক সংস্থা বেঙ্গল মিটের সৈয়দ হাসান হাবিব বলেন, তাকে আন্তর্জাতিক চাহিদার শতকরা ৭৫ ভাগ বাতিল করতে হয়েছে। ভারতের এই দমননীতির আগে তিনি বছরে উপসাগরীয় দেশগুলোতে ১২৫ টন মাংস রপ্তানি করতেন। তার কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন সভাপতি শাহিন আহমেদের কণ্ঠে। তিনি বললেন, চামড়া স্বল্পতার কারণে ১৯০টি ট্যানারির মধ্যে ৩০টি কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে ৪ হাজার মানুষ কর্মক্ষম হয়ে পড়েছেন।
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত একটি জরিপ অনুযায়ী, মোদি ও রাজনাথ সিং সরকারকে বাড়তি গরুকে খাওয়াতে ও তা পালনের জন্য স্থান দিতে বছরে ৩১ হাজার কোটি রুপি খরচ করতে হবে, যদি বিএসএফ স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে এসব গরু সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
অবশ্যই ভারতের এই নতুন গরু-নীতির দায়ভার বহন করতে হবে দেশের সাধারণ করদাতাদের। তাই কোনটি উচিত সব ভারতীয়ের জন্য সে বিষয়ে এখন প্রয়োজন একটি জন বিতর্ক। শুধু অর্থনীতির জন্য নয় বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বন্দ্বমুক্ত একটি সম্পর্কের কারণে এ নিয়ে অবশ্যই নতুন করে চিন্তা করতে হবে। এটা ভারতের নিরাপত্তার জন্যও প্রয়োজন। একই সঙ্গে এ অঞ্চলে ভারতের প্রভাব নিশ্চিতের জন্যও তা করা উচিত।
(গতকাল অনলাইন আরব নিউজে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ)

No comments:

Post a Comment