Wednesday, June 6, 2012

স্বপ্নজয়ী জয়নাল

ময়মনসিংহে গরিবের বন্ধু জয়নাল আবেদিন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এখন ফলাও করে রিপোর্ট প্রকাশ হচ্ছে তাকে নিয়ে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে মানবসেবার যে উজ্জ্বল কীর্তি তিনি স্থাপন করেছেন, তার খবর পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্ববাসীর কাছে। গতকাল অনলাইন বিবিসিতে প্রকাশিত আনবারাসান ইতিরাজনের লেখা সচিত্র রিপোর্টে বলা হয়, জয়নাল আবেদিন ময়মনসিংহের তানাশাদিয়া
 গ্রামের এক হতদরিদ্র মানুষ। ৩০ বছর আগে তার পিতা বিনা চিকিৎসায় মারা যান। তখন থেকে তার মধ্যে জেদ চেপে বসে- একটি হাসপাতাল স্থাপন করবেন নিজের গ্রামে। সেখানে চিকিৎসা নেবে গরিব মানুষ। তাই তিনি প্রায় ২০ বছর ঢাকায় রিকশা চালিয়ে তার স্ত্রীর অজান্তে ব্যাংকে জমা করেছেন কিছু কিছু করে অর্থ। তা দিয়ে তানাশাদিয়া গ্রামে স্থাপন করেছেন মুমতাজ হাসপাতাল। সেখানে এখন চিকিৎসা নেয় গরিব মানুষ। তা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন জয়নাল আবেদিন। তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তার পিতা যখন বিনা চিকিৎসায় মারা যান তখন ওই গ্রামের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিক ছিল না। তখন তিনি ছিলেন একজন সামান্য দিনমজুর। তবু তার মনে আশা জাগে, নিজ গ্রামে হাসপাতাল স্থাপন করার। তারপর স্ত্রী লাল বানুকে সঙ্গে নিয়ে আয়-উপার্জনের জন্য আসেন ঢাকায়। জয়নাল আবেদিন বলেন, তখন ঢাকা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না আমাদের। এত বড় শহর দেখে আমরা বিস্মিত হয়ে যাই। প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি কিভাবে এই শহরে টিকে থাকবো। পরে রিকশা চালানো শুরু করি। কিন্তু ভীষণ ট্রাফিক জ্যামের ভেতর এ কাজটি সহজ ছিল না। আস্তে আস্তে শিখে নেন বাস-ট্রাকের ভেতর দিয়ে নিরাপদে রিকশা চালানো। এভাবে দুই দশক তিনি রিকশা চালান। যাত্রী ও পণ্য বহন করেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। তার জীবনের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে সাংবাদিক আনবারাসান ইতিরাজন সরজমিন গিয়েছিলেন ময়মনসিংহ। তিনি সেখান থেকে লিখেছেন- জয়নাল আবেদিনের স্ত্রী লাল বানু ঢাকার একটি ক্লিনিকে কাজ পেয়ে যান। তার কাছে একটি কথা গোপন রাখেন জয়নাল। তা হলো- গোপনে তিনি একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। সেখানে গোপনেই রিকশা চালানো টাকা থেকে জমাতে থাকেন। জয়নাল বলেছেন- এ নিয়ে মাঝে মধ্যেই আমার স্ত্রী প্রশ্ন তুলতো। সে জানতে চাইতো, আমি কেন অন্যদের মতো বেশি টাকা উপার্জন করতে পারি না। আমি সব সময়ই গোপনে টাকা জমা করেছি। সে বেশি টাকার মুখ দেখবে কিভাবে! সংসারের টানাপড়েনের সময়ও আমি টাকা জমা করেছি। যত কষ্টই হোক সংসারে, আমি কখনও ওই জমানো টাকায় হাত দেইনি। যখন আমার ব্যাংক একাউন্টে ৪০০০ ডলারের কিছু বেশি জমা হলো, সিদ্ধান্ত নিলাম এবার গ্রামে ফিরে যাবো। বিবিসি লিখেছে- তিনি গ্রামে ফিরে গিয়ে একটি ছোট্ট জমি কেনেন তার জমানো টাকা দিয়ে। সেখানে টিনের একটি ঘর তোলেন নিজের জন্য। আরেকটি শেড নির্মাণ করেন ক্লিনিকের জন্য। বাকি অর্থে কেনেন কিছু ওষুধ এবং ক্লিনিকের জন্য বেড। এক পর্যায়ে তিনি এ বিষয়ে গ্রামের লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু তাদের কেউ তাকে তেমন গুরুত্ব দেন না। জয়নাল আবেদিন বলেন, লোকজন আমার কথা শুনে হাসাহাসি করে। তারা বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, একজন রিকশাচালক একটি ক্লিনিক স্থাপন করতে পারে। এমন কি কোন চিকিৎসকও এই ক্লিনিকে আসতে রাজি হলেন না। তারপর তিনি ক্লিনিকের নাম দিলেন মুমতাজ হাসপাতাল। প্রথম দিকে তিনি একজন প্যারামেডিককে অনুরোধ করলেন সেখানে বসে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে। এ খবর যখন ছড়িয়ে পড়লো, তখন গ্রামের অনেক মানুষ প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য আসতে থাকে তার ক্লিনিকে। যাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বা খারাপ তাদের ময়মনসিংহ শহরে বড় হাসপাতালে পাঠানো হয়। এভাবে প্রতিদিন এই ক্লিনিক থেকে ১০০ মানুষকে চিকিৎসা দেয়া হয়। স্থানীয় একজন প্যারামেডিক সেখানে বসেন। সপ্তাহের একদিন একজন চিকিৎসক বসেন দর্শনীর ভিত্তিতে। স্থানীয় লোকজন ও কিছু কোম্পানির সহযোগিতায় জয়নাল আবেদিন সেখানে স্থাপন করেন ফার্মেসি। সেখান থেকে রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেয়া হয়। এই হাসপাতালে জ্বর, ডায়রিয়া, ছোটখাটো আঘাত ও অ্যাজমার মতো রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়। এখানে নারীদের জন্য রয়েছে ম্যাটার্নিটি কার্ড। এখন আশপাশের এলাকার মানুষের মুখে জয়নাল আবেদিনের গুণগান। তারা সবাই সাবেক এই রিকশাচালকের দৃঢ় প্রত্যয় ও সাহসের প্রশংসা করেন। পাশের গ্রামের আবদুল মালিক বলেন, এই হাসপাতাল এ অঞ্চলে আমাদের মতো গরিব মানুষদের চিকিৎসা দিয়ে থাকে। সরকারি হাসপাতাল এখান থেকে অনেক দূরে। আমাদের সামর্থ্য নেই বেসরকারি ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসা করানোর। তাই আমরা এখানেই আসি। যখন স্থানীয় মিডিয়ায় জয়নাল আবেদীনের কাজ ও ক্লিনিক নিয়ে লেখালেখির পর অনেকেই তাকে অর্থ দিয়েছেন। তা দিয়ে তিনি ক্লিনিক প্রশস্ত করেছেন। শুরু করেছেন প্রাথমিক স্কুল পড়ুয়াদের জন্য একটি কোচিং সেন্টার। সেখানে দিনমজুর ও কৃষকদের সন্তানদের পড়ানো হয়। এখন সেখানে বাংলা, আরবি, গণিত ও ইংরেজি পড়ে কমপক্ষে ১৫০ জন ছাত্রছাত্রী। ময়মনসিংহ জেলার সিনিয়র কর্মকর্তা লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, ওই এলাকায় যথার্থ কোন হাসপাতাল নেই। তার পরও আবেদিনের হাসপাতাল গ্রামবাসীকে গুরুত্বপূর্ণ সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তিনি আমাদের দেশের আদর্শ হয়ে উঠেছেন এ কাজের মাধ্যমে। তিনি ছাত্রছাত্রীদের দিয়েছেন বিনামূল্যে বই। এখনও চেষ্টা করছেন তার ক্লিনিকের জন্য অর্থ যোগাড় করতে। রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের মতো একটি দেশে একজন রিকশাচালক তার প্রায় সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে অন্যদের জন্য ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করবেন- এমনটা বিরল। এখানে রিকশাচালকরা সমাজের একেবারে তলার মানুষ। তারা দিনে এক ডলারেরও কম আয় করেন। জয়নাল আবেদিন এক বছর হলো অসুস্থতার জন্য রিকশা চালানো ছেড়ে দিয়েছেন। এখন ক্লিনিক নিয়েই আছেন। তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন এই ক্লিনিককে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালে পরিণত করা।

No comments:

Post a Comment