Tuesday, October 2, 2012

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন, নারী হয়ে নারীর বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা


যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্বে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে চ্যাম্পিয়ন ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে তিনি আক্রমণাত্মক সব কাজ করছেন। ‘উইমেন হার্টিং উইমেন’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনটির লেখক নিকোলাস ডি ক্রিস্টফ। তিনি ওই প্রতিবেদনে বিশ্বে নারীর অগ্রযাত্রার সামনে নারীকেই বাধা হিসেবে দেখিয়েছেন। প্রশ্ন তুলেছেন- বিশ্বের নারীদের জন্য কি নারী নেতৃত্ব ভাল? ওই প্রতিবেদনে তিনি আরও লিখেছেন, ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি নারীদের দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করতে সহায়তা করেছেন। তাকে তারই প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে এরই মধ্যে সরিয়ে দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। আরও খারাপ খবর হলো- গত মাস থেকে তার সরকার প্রায় ৫৫ লাখ স্বল্প পুঁজির মালিকানা গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এ ব্যাংকের ওই সব শেয়ারহোল্ডারদের বেশির ভাগই নারী। তারা সম্মিলিতভাবে ব্যাংকের শতকরা ৯৫ ভাগেরও  বেশি মালিক। অথচ কি এক উল্টো চিত্র দেখছি আমরা! নারীর বৈষম্যের কথা বলে ক্ষমতায় এসেছেন যে নারী তিনিই এখন ক্ষমতার বলে এমন একজন পুরুষের সারাজীবনের অর্জনকে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করছেন। বিশ্বের সবচেয়ে অসহায় নারীদের জন্য এই পুরুষ মানুষটি যা করেছেন ততটা হয়তো এ বিশ্বের আর কেউ করেননি। ড. ইউনূস, তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, কর দেয়া সহ বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এতে তার সমর্থকরা আতঙ্কে রয়েছেন। তারা মনে করছেন, তাকে এর কোন একটির অজুহাতে বা অন্য কোন কারণ দেখিয়ে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। নিউ ইয়র্কে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ-এ কয়েকদিন আগে ড. ইউনূস বলেছেন, এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে আছি। আমি ঠিক জানি না কিভাবে এর মোকাবিলা করবো। ড. ইউনূস বলেন, সরকার যদি গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারি ব্যাংকে রূপান্তরিত করে তাহলে এর সবটাই শেষ হয়ে যাবে। নিকোলাস ডি ক্রিস্টফ লিখেছেন,  জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্কে রয়েছেন। তিনি প্রথমেই গ্রান্ড হায়াত হোটেলে আমাকে একটি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে তিনি তা বাতিল করেন। নতুন করে সময় দেয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেন। নিকোলাস ডি লিখেছেন, সম্ভবত এতে কেউ বিস্মিত হবেন না। যখন একজন নারীর নেতৃত্বে একটি জাতি পরিচালিত হচ্ছে তখন মেয়ে শিক্ষার হার বাড়েনি, কমেনি মাতৃমৃত্যুর হার। এ বিষয়ে প্রমাণ আছে যে, এই দেশের নারীরা স্থানীয় পর্যায়ে ও কর্পোরেট বোর্ডে  রয়েছেন। কিন্তু জাতীয় উন্নয়নে তাদের সত্যিকার কোন ভূমিকা নেই। নারীর বিনিয়োগ থেকে সুবিধা পাওয়া একটি প্রকৃত বড় উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। যখন ১৯৭১ সালে এ দেশটি পাকিস্তানের কাছ থেকে আলাদা হলো তখন এ দেশটি ছিল এক ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু এ দেশ নারী শিক্ষায় বিনিয়োগ করেছে। তাই বর্তমানে এদেশের হাই স্কুল পড়ুয়াদের অর্ধেকের বেশি হলো নারী। একটি মুসলিম দরিদ্র দেশের জন্য এটা এক বিস্ময়কর অর্জন। বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের ভিত্তি রচনা করেছেন এসব শিক্ষিত নারী। তাদের সন্তান জন্ম দেয়ার বিষয়টি কমে গেছে। বাংলাদেশে গড়ে এখন একজন নারী ২.২টি সন্তানের মা। ১৯৮০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬। নারীদের মূলধারায় নিয়ে আসায় চরমপন্থা দুর্বল হয়েছে। ফলে পাকিস্তানের চেয়ে এখানে এ নিয়ে উদ্বেগ কম। পাকিস্তানে উপজাতীয় এলাকাগুলোতে নারী শিক্ষার হার শতকরা মাত্র ৩ ভাগ। কৃতজ্ঞতা হিসেবে ড. ইউনূসের বিষয়ে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। তিনি বলেছেন, আমি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে খুব বেশি শ্রদ্ধা করি। তিনি যে কাজ করেছেন আমি তার প্রতিও শ্রদ্ধা করি। আমি চাই কোন ধরনের বাধা-বিপত্তি ছাড়া অথবা সরকারের কোন কর্মকাণ্ড দ্বারা বাধা ছাড়াই তিনি তার সেই কাজে এগিয়ে যাক। হিলারি এসব কথা বলেছেন এ বছরের শুরুর দিকে। এ বিষয়ে শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ শুলৎস ও ম্যাডেলিন অলব্রাইট। কিন্তু শেখ হাসিনা তাতে সাড়া দিয়েছেন বলে কোন ইঙ্গিত মেলেনি। এ বিষয়ে একটি তত্ত্ব হলো যে, শেখ হাসিনা আতঙ্কগ্রস্ত। তিনি ড. ইউনূসকে হুমকি হিসেবে দেখছেন, বিশেষ করে তখন থেকে যখন তিনি ২০০৭ সালে রাজনীতিতে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন। অন্য তত্ত্বটি হলো- তার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় ও বিশ্বজুড়ে সুনাম কুড়ানোয় পরশ্রীকাতর হয়ে পড়েছেন। শেখ হাসিনা আরও অনেকভাবে হতাশাগ্রস্ত। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর হত্যা ঘটনায় তিনি চোখ বন্ধ করে আছেন। নিকোলাস ডি ক্রিস্টফ লিখেছেন, টাইমস-এ আমার সহকর্মী জিম ইয়ার্ডলি এই সেপ্টেম্বরে একজন শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম সম্পর্কে লিখেছেন। ওই শ্রমিক নেতাকে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল। পরে তার নির্যাতিত মৃতদেহ পাওয়া যায় পরিত্যক্ত অবস্থায়। ইউনূস-ভক্তরা চেঞ্জ ডট ওআরজি নামে একটি ওয়েবসাইটে তার পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন। নিকোলাস আরও লিখেছেন, ড. ইউনূসের পক্ষে আরও মার্কিন কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ কথা বলুন আমি তা চাই। ড. ইউনূসের সঙ্গে আরেকটা ছবি হলে কেমন হয় প্রেসিডেন্ট ওবামা? তিনি আরও লিখেছেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি দেশে ও বিদেশে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ থেকে কর্পোরেট বোর্ডে আমাদের আরও নারী নেতৃত্ব প্রয়োজন। তথ্যপ্রমাণ এটাই বলে দেয় যে, বহুমাত্রিক নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। আমি আরও বিশ্বাস করি, নারী নেতৃত্বের পরবর্তী প্রজন্ম নারীদের বিষয়গুলোকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে তাতে বলা যায়, নারীর সমতার জন্য যে যুদ্ধ, তা কেবলই নারী ও পুরুষের মধ্যের লিঙ্গগত সংগ্রাম নয়। এটি আরও সূক্ষ্ম একটি বিষয়। নারীবিদ্বেষ ও নারীর প্রতি অবহেলা এখনও একটি বৈশ্বিক সমস্যা। তবে এই সঙ্কট ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে পুরুষ ও নারী উভয়ই দায়ী।

No comments:

Post a Comment